পাগলরা সব নিরুদ্দেশ
বাউন্ডূলে রবীন
সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসে এটা যেমন সত্য । পৃথিবীও সূর্যে চারদিকে ঘুরে এটাও তেমন সত্য । এক এক দেশে আলোর উপস্থিতি এক এক সময়ে । আর চাঁদের আলো সেটাও তো সূর্যের আলোর প্রতিফলন । শক্তি বা আলো যখন যেখান থেকেই আসুক না উৎস কিন্তু একটা । বাংলা শব্দ ভান্ডারে এমন একটা শব্দ আছে যে শব্দ অনেক কিছুর সঙ্গে যায় । চিংড়ী মাছের মত সব তরকারীতে যায় । পাগল, পাগল শব্দটা অদ্ভূত । টাকার পাগল, জ্ঞানের পাগল, প্রেম পাগল, বউ পাগল, জামাই পাগল, রূপের পাগল, ন্যাংটা পাগল, ভবের পাগল, ক্ষমতা পাগল, আল্লাহর পাগল । মোট কথায় আমরা সবাই পাগল । সব মানুষের পাগলামী করার সহজাত কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে মানুষ ঘুরছে পৃথিবীতে । জিদ বা রাগ পাগলামি তৈরি হওয়া জিনেরই অংশ । রাগ, জিদের সময় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় তখন যা করে ওটাই পাগলামী । মানুষ কি তাহলে নিজেই চাইলে পাগলামী নিয়ন্ত্রন করতে পারে? না । কিছু কিছু পাগল আছে যারা মোহে পাগল । সার্কিট ছিড়া পাগলদের এক এক রকম আচরন । চোখের সামনে সুস্থ মানুষ থেকে ধীরে ধীরে উন্মাদ পাগল হয়ে যেতে দেখিছি । পাগল হয়ে যাওয়ার কলকাটি উপর থেকে নিয়ন্ত্রন হয় । সুস্হ মানুষের বিচার হবে হাশরে । পাগল যে উন্মাদ তাদের ইবাদত বন্দিগীতে ছাড় দিয়েছেন রাব্বুল আলামিন । বিচারের দিন এদের ছাড় হবে মনে হয় । পৃথিবীর ভোগ বিলাসীতায় মত্ত হইবার মোহে পড়ে আমরা যে সকল পাগলামি করি তার কঠিন বিচার হবে ।
ইলিয়াছ লিভ অব এ্যাভসেন্স এ্যাপলিকেশন এক ধমে বলে ফেলছে । তার হাতের লিখা মুক্তার দানার মত বেধানার দানার মত হলে খাওয়া যেত । মুক্তা দিয়ে অলংকার তৈরি করা হয় দামি জিনিস । ইলিয়াস ছাত্র হিসেবে অনেক ব্রিলিয়ান্ট তাই ও অনেক দামি । ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া লিখা করেছে । আমাদের সাথের অনেক ছাত্র ঝরে গেছে কিন্তু ওর ঝরে যাওয়ার কারন অর্থাভাব । বাবা নেই, মা ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ নাই । ক্লাস এইটে পড়া একটা ১৩বছরের কিশোরের কাঁধে সংসার নামক গাঁধাটা যদি চড়ে । তাকে টেনে নেওটা বেশ কষ্টের । তার সহপাঠীরা যায় স্কুলে আর সে যায় মাটি কাটার কাজে মুজুরী খাটতে । আমাদের স্কুলের কাছেই ছিল ওর নানা বাড়ি এখানে থাকতো । মানুষের মুজুরী খাটে এই মানসিক চাপটা সে ঐ বয়সটা নিতে পারে নাই । নাইন টেন এর এই দুই বছর আর দেখি নাই, লোক মুখে শুনেছি মাথায় নাকি গন্ডগোল দেখা দিছে । বেঁধে রাখা হয় গাছের সাথে । দরধী মা দিসেহারা একটা সন্তান তার আবার মাথায় সমস্যা । আজ ১৯ বছর পর উপলদ্বি করলাম আসলে ওর মাথাটা নষ্ট হয়েছে পড়া লেখা না করতে পারার বেদনায় । আমার সাথে দোকেনে রাস্তা ঘাটে দেখা হলে আমি যখন বলতাম কিরে ইলিয়াস কি খবর তোর । কিছু বলতো না । যখন বলতাম কিছু খাবি খুব খুশি হয়ে একটা হাসি দিতো । ভুবন ভুলানো হাসি, দাঁত গুলো তার হলুদ কালো হয়ে গেছে পানের আর বিড়ির রসে । চা খাইতো বড় জোর দুইটা বিস্কুট খাইতো । সিগারেট নিতে বললে দুই প্যাকেট বিড়ি নিতো । ইলিয়াস আমারে মামু ডাকতো । যাওয়ার সময় মামু যাই বলে খুব খুশি খুশি মনে চলে যেত বিড়ি টানতে টানতে । আমার কাছে মনে হয়নি কোন দিন ওর মাথায় সমস্যা । সমাজের মানুষ মাথায় সমস্যা বলে পয়দা লুটতো । বুঝলাম কিভাবে? একদিন আামাদের বাড়িতে আসছিলো আব্বার কাছে বিচার নিয়ে তখন আমি ঘরের ভিতর থেকে শুনছিলাম কে যেন তারে দিয়ে কাজ করিয়ে কাজের টাকা দিচ্ছে না । আহ! মানুষের কত বিচিত্র চরিত্র । ঢাকা থেকে এখনো দুই ঈদে বাড়ি গেলে মানুষ জনের কাছে জিজ্ঞাসা করি ইলিয়াসের কথা কেউ বলতে পারে না ।পাগলের খোঁজ কেউ রাখে না । পাগলারা রাস্তার জিনিস । রাস্তায় রা্স্তায় ঘুরবে কেউ কিছু দিলে খাবে না হয় খুঁজে খাবে কেড়ে নিয়ে খাবে না । এরা নিজেদের ভুবনে বিচরন করে । নিজেদের জগতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না । নিজেদের মাঝে নিজেদের গুটিয়ে রাখে ।
আমরা স্কুলে যাবার পথে ক্বারী শাহ এর বাড়ী ছিলো । ক্বারী শাহর এক ছেলের নাম ছিল মোস্তফা পাটোওয়ারী । লোকজন ডাকতো হাডারী বলে । কি কারনে ওনার মাথা গরম হতো জানি না । তবে মাথা গরম হলে মাঝে মাঝে কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে রাখা হতো । আমরা খুব ভয় পেতাম । কিন্তু কখনো দেখিনি কাউকে দৌড়াতে বা মারতে । কেউ যদি জিজ্ঞাসা করতো হাডারী ভালানি বলতো হ্যাঁ ভালো । মাথা সমস্যা বলতে ওনি নিজে নিজে কথা বলতেন আর হাত নাড়াতেন । ওনি পল্লীবিদুৎতে চাকরি করতেন। পাগলামির কারনে চাকরিটা চলে গেছে । প্রায় পাঁচ ছয় বছর দিখেছি । নিজে নিজে কথা বলে ঠিক আছে কেউ কিছু এনে দিতে বললে করে দিতো । ফজিউল্লাহ তার চায়ের দোকেনের পানি মোস্তফা পাটোওয়ারীরে দিয়ে আনতে । মানুষের কথা শুনতো, কাজ করে দিতো । সে কিভাবে পাগল হয়? অস্পষ্ট মনের আওড়ানো কথাগুলো বলতো এটা কি পাগলামী? হারিয়ে গেছে হঠাৎ প্রতিদিনের মত ঐ দিনও বের হয়েছিলো বাড়ি থেকে আর বাড়ি ফিরেনি । যে দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে আর বাড়ি ফিরেনি সেই দিনই চুড়ান্ত পাগল হয়ে গিয়েছিল । পাগল থাকা অবস্থায় তিনি দুই সন্তানের জনক হয়েছিলেন । পাগলামি মানুষের ব্রেনের তৈরি করা কোন মোহ ছাড়া আর কিছু না । এই মোহ কেউ নিজে তৈরি করে নিয়ন্ত্রন নিজের মধ্যে নিতে পারে । আর কিছু মোহ অদৃশ্য, কোথায় হতে যেন মুভির মত নিয়ন্ত্রিত হয় । পাটোওয়ারী কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি ।তারা আর ফিরে আসে না ।
কালো জাদু করে নাকি মানুষকে পাগল বানিয়ে দেওয়া যায় । ছোট বেলায় শুনেছি বস রে তাবিজ করে পাগল বানানো হলো । সে তাবিজ নাকি কচ্ছপের গলায় পড়িয়ে দেওয়া হয়ছে । তাই গলা কচ্ছপের মত গলা টান টান করে দাঁত গিজগিজি দিয়ে বিড়বিড় করে মনের রেকর্ডারের কথাগুলো বাজাতো । শার্ট ইন করা পায়ে কেডস জুতা পড়া শুকনো পাট কাঠির গড়নের দেহ বাবড়ি চুল বাতাসে উড়িয়ে কালো চশমা ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট ধরানো আমাদের পরিচিত বস । বসের সংসারে বস ছাড়া কেউ নাই। অনেক সম্পদের মালিক বসের দেখাশুনা চাচাতো ভাইয়েরা করে । প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা আর এক প্যাকেট নেভি সিগারেট খাওয়া দাওয়া তাদের সাথে । এই জগৎ সংসারের চিন্তাহীন চলে যাওয়া জীবন বসের । বস দোকান পাটে চা বিস্কুট সাদলে খাইতো হাসতো । আবার মাঝে মাঝে নিজের চিরাচরিত দাঁত গিজে মনের আওড়ানো কথাগুলো আওড়াতো । কেউ কখনো জানতে চায়নি কার উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলে যায় । কিবা ছিল কথাগুলোর অর্থ । বাড়ি দোকানপাটে বিচরন গ্রামের বাহিরে যায়নি কখনো । বাড়ি চিনে ঘর চিনে একা আসে একা যায় কারো সাহায্য ছাড়ায় । বস কি সুস্থই ছিল? নষ্ট হয়ে যাওয়া সমাজের বাহিরে নিজেকে আড়াল করে রাখার অভিনব এই কায়দা । সমাজের মানুষদের সাথে থেকেও সামাজ থেকে দূরে অদৃশ্য অজানায় নিজ ভূবনের তৈরীকৃত সমাজ বাস করা । কেউ কখনো চেষ্টা করেনি বরং দূরে ঠেলে নিজেদের দ্বায় সারতে চায় সম্পদ ভোগের লোভে । আমার মত করে অনুভব করার চেষ্টা কেউ করেনি হয়তো । মানুষের পাগলামীর সহজাত স্বভাব থেকে ছোটবেলার দেখে আসা পাগলদের কথা অনুভূত হয়েছে তাই নয় কি? নিশ্চয় তাই ।
মেইন রাস্তা থেকে আমাদের বাড়ির দিকে যাওয়ার রাস্তার কাছে আসলে সিরাজ পাগলা এত বিকট চিৎকারে হক হক বলে উঠতো । বাড়ি থেকে শুনতে পেতাম ।সামনা সামনি এভাবে চিৎকার করে উঠলে ভয় পেতাম সেই ছোট বেলায় । সিরাজ পাগলার বাড়ি ছিলো কান্দিপাড়, আমাদের পাশের গ্রাম । লাল শালুর পেছানো লুঙ্গি মাথায় জটলা লাগানো চুল কপালের উপর দিয়ে লাল গামছা দিয়ে বাঁধা ।গলায় ছোটবড় হরেক রকম তচবি মালা দুই হাতে অনেকগুলি নানান নকশার চুড়ি । হাতে স্টিলের ছোট বালতির মত ডাকনা দেওয়া তালা লাগানো তার সন্ধুক আর একটা ঘুংঘুরমুংঘুর লাগানো লাঠি । প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো । একদিন আমার ছোট চাচা ধরছে যে সিরাজ তোর বালতির ভিতর কি আছে দেখবো । সিরাজ দেখাবেনা আমার চাচা নাচোর বান্দা দেখাতে হবে জোর করে কিল থাপ্পর দিয়ে চাচা বালতি নিয়ে গেল । কিল থাপ্পর খেয়েও খিলখিল করে হাসতেছে । আমরা খুব মজা পাচ্ছিলাম । কাকা কে খুব ভয় পাইতো আর সমীহ করতো । তাই সিরাজ পাগলা বলতেছিলো আব্বা এইবার আজমীর শরীফ থেকে তোর জন্য দামি একটা পাথর এনে দিবো । না, কাকা রে কোন ভাবে রাজি করাতে পারেনি কোন রকম প্রলোভন কাজে দিলো না । অবশেষে কাকা জোর করে চাবি নিয়ে খুললেন । খুলে হাবিজাবি কত কি নানা রংয়ের অনেকগুলো পাথর আর বড় বড় দুটা গাঁজার ফোটলা । গাঁজার ফোটলার জন্যই এত গড়িমসি করেছিল । সিরাজ পাগলাও একদিন এলাকা ছেড়ে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি । ভারতে যদি সত্যি আজমীর শরীফ যাওয়া আসা থেকে থাকে তাহলে ধরে নিলাম সে আজমীর গেছে সেখান থেকে ফিরে আসেনি হয়তো কোন একদিন ফিরবে । তিনি যেহেতু অদৃশ্য নিরাকার কে তালাশের জন্য এই ব্যাশবুশা ধরেছেন তার ভাষ্যানুযায়ী আর চলন বলনে তাই বলে । এই পাগলামী নিজের তৈরি স্পষ্ট । নিরাকারের সন্দানে এই রকম পাগলামীর ব্যাশ ধরতে হয় কোথাও এই রকমের দিক নির্দেশনা স্রষ্টা তার কোন পয়গম্বরের মাধ্যমে নির্দেশনা দিয়েছেন তার প্রমান নেই । সিরাজ পাগলার ব্যাশবুশার অনেক পাগল দেখেছি দেশের নানা প্রান্তে । তবে এই ক্যাটাগরির পাগলদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করে তারা পাথর ব্যবসা করে, যে যত ভীতু তার কাছ থেকে তত চড়া দাম তারা হাতিয়ে নেয় । এ রকমের পাগলদের আনাগোনা থাকে মাজারের আশে পাশে ।
রিক্সা চালিয়ে সংসার চলছে ভালোই মান্নানের । উনার বাড়িও আমাদের পাশের গ্রামে আর চেনা পরিচিত ছিলো বলে ছোট বেলা আমাদের স্ট্যান্ডে দেখলে হাসি দিয়ে বলতেন আব্বারা কি খবর ভালো আছেন । আমরা ঐভাবে ছোট সময় চিনতাম না । আমাদেরকে চিনতেন আমরা কে কার সন্তান । সদায় হাস্যোজ্জোল মান্নান কাকা উনিও পাগল হয়েছেন ব্যাশবুশায় না মনে মনে । মাথায় গামছা বাঁধা থাকে সবসময় আর মুখে “কোন সাধনে পাবো তোমারে ও মুর্শিদ ধনরে” এই টাইপের মুর্শিদি গান । ওনার পাগলামী হচ্ছে উনি ভাত খান না । ভাত না খাওয়ার পিছনে রয়েছে বিচিত্র এক কারন । শুনা কথা উনি নাকি একদিন এক লোককে নিয়ে ভাড়িতে গেছেন রাতের বেলায় আর উনার স্ত্রীকে ভাত দিতে বললেন । পরিচয় পর্বে উনার স্ত্রী যখন জানতে পারলেন ঐ লোকটার পেশায় সুইপার তখন উনাদের ভাত দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন । ঐদিন থেকে মান্নান কাকা ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিলেন । যে ভাতের চাল,প্লেট উনার রুজির টাকার কেনায় শুধু পেশার কারনে মানুষ মানুষে ভিন্ন করে সে ভাত খেতে আর তিনি রাজি নয় ।মানুষ মানুষে অভিন্ন এই মানবিক দর্শন ধারন করে নিজের সাথে নিজের পাগলামী । গ্রামে গেলে দেখা হয়, এখনো সেই ছোট সময়ের মত দেখলে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করবেন আব্বা ভালো আছেন,কখন আইছেন ? মানুষের মাঝেই স্রষ্টার বিচরন । “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, নইলে পরে ক্ষেপারে তুই মুল হারাবি” ফকির লালন শাহ এর দর্শন । মানুষ এক খোদার সৃষ্টি এই মানুষের ভিতরে কার কি আছে বাহ্যিক দৃষ্টি দিয়ে উপলব্দি করা যায় না । বুঝতে হয় মানুষকে বিবেক দিয়ে প্রবেশ করতে অন্তর আত্মায় ।
অনলাইনে উপস্থিত | |
সদস্য: ০ | অতিথি: ১ |
৩৩০৮৯ | |
আজ | ৫ |
গতকাল | ৪ |
এই সপ্তাহে | ১৭ |
এই মাসে | ৩৭ |